top of page
Short Films

film

SHORT

শর্ট ফিল্ম

স্বর্ভানু সান্যাল

[কিছু অধুনা অখাদ্য ছোট ছবি দেখে আমার কিঞ্চিত অগ্নিমান্দ্য হয়েছিল। তারই প্রভাব পড়েছে লেখায়। সমস্ত শর্ট ফিল্মই নিকৃষ্টমানের, এরকম জেনেরালাইজেশান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তাও যদি কোন কথা প্রাণে বাজে কিম্বা কানে বাজে, লেখককে নেহাত বায়ুরোগগ্রস্ত মনে করে নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। বলা বাহুল্য, অবশ্যই ভালো শর্ট ফিল্ম হচ্ছে। এবং বাংলা সিনে-লাভাররা নিশ্চয়ই সেইসব শর্ট ফিল্ম দেখুন এবং প্রোমোট করুন।]

বাঙালি হচ্ছে সংস্কৃতিমনস্ক জাতি বাওয়া। যেদিন আমাদের বাড়িতে ঘর আলো করে সন্তান আসে, সেদিন শঙ্খ-ঘন্টা-ঢক্কা-নিনাদ সহকারে স্বয়ং দেবী সরস্বতী বীণা-রঞ্জিত-পুস্তক-হস্তে বাড়ি এসে পড়েন আর নবজাতকের বাঁ কাঁধে পাঁচ কেজি আর ডান কাঁধে পাঁচ কেজি সংস্কৃতির বোঝা চাপিয়ে দিয়ে যান। আর তারপরেই আসেন রবি ঠাকুর। এসে মাকে অনুরোধ করেন মা “তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি”। মা-ও ঠাকুর সন্দর্শনে হৃষ্টচিত্তে বলে দেন "তথাস্তু"। আর সেই তখন থেকেই আমরা হৃদিকুম্ভে সংস্কৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াই। আমাদের আচারে সংস্কৃতি, বিচারে সংস্কৃতি, প্রচারে সংস্কৃতি, সদাচারে সংস্কৃতি, অত্যাচারে সংস্কৃতি, মিথ্যাচারে সংস্কৃতি। সৃজনশীলতা বা creativity আমাদের যাকে বলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমরা মৃনাল সেন-এর বংশ বাওয়া। সত্যজিৎ রে আমাদের সংস্কৃতি যজ্ঞে তন্ত্রধারক। না না আনপড় গাঁওয়ারদের মত "সত্যজিৎ রায়" আমি বলি না। সুকুমার ভদ্রলোক ননসেন্স ভার্সেস লিখতেন, উনি রায় হোন, কিন্তু তার ছেলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সত্যজিৎ বাবুকে রে বলাই দস্তুর। 

 

আমরা খোট্টাও নই, মাল্লুও নই। খোট্টারা গেলে ছাতু। মাল্লুরা গেলে মাল্লু আর পর্ন। আমরা রবি ঠাকুরের সাহিত্য অমৃতকুম্ভে মুখ ডুবিয়ে বুড়বুড়ি কাটি। মন্দির মসজিদ নয়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করি। আমাদের ঘরে ঘরে লেখক, চিত্রকার, নাট্যকার, নাট্যশিল্পী। মানে আগে এই পর্যন্ত ছিল। কিন্তু এখন প্রগতির সাথে হাত মিলিয়ে ঘরে ঘরে চিত্র পরিচালক। ট্যাঁকে তেমন টাকা নেই তাই সংক্ষিপ্ত ছায়াছবি বানাই মানে short film আর কি। তবে মনে রাখবেন “ঋত্বিক ঘটক, ঋতুপর্ণকে মারিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে”।  দু  চারটে শর্টফ্লিম আমার ভাইরাল হতে দিন। তারপর দেখুন ফরাসি ফিল্ম ফেস্টিভাল-এ আমার ছবি চলবে রমরম করে। ছোট্ট তন্বী ব্ল্যাক লেডির সুখস্পর্শ নিতে নিতে ফিল্ম ফেয়ারের রেড কার্পেটে হাঁটবো। উপরি পাওনা হিসেবে যে কেট উইন্সলেটের-এর মসৃণ কোমরে হাত রাখতে পারব না এমনটা কে বলতে পারে!

 

প্রগতির আর এক নাম শর্টফিল্ম। প্রগতিশীলতার আর এক নাম অনস্ক্রীন দীর্ঘ চুম্বন - বুঝলেন কিনা। দেশের অন্যান্য প্রদেশের মানুষ, ওদের সৃজনী শক্তি বলতে ঐ একটাই..বাচ্চা পয়দা করা। কিন্তু আমরা রত্নগর্ভা। আগে প্রসব করতাম সাহিত্য কিন্তু এখন সেটা dead form of art. তাই এখন বানাই সিনেমা। আমাদের আছে রবীন্দ্রনাথ, মৃণাল সেন, যামিনী রয়। কি বললেন? রবীন্দ্রনাথের কটা উপন্যাস পড়েছি? ছো..এরকম ছেঁদো কথা বলবেন না তো। রবীন্দ্রনাথ একটা আইডিয়া, একটা ধর্ম, রবীন্দ্রনাথ মানে ধুনোর গন্ধের মত একটা বিমূর্ত ভাব, হ্যামলিনের বাঁশির মত একটা দূরাগত শ্রুতি। "নয়ন সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়াছ যে ঠাঁই" - সেই ওনার কথার খেই ধরেই বলি, উনি আমাদের বইয়ের মানুষ নন, মনের মানুষ। আর তাছাড়া এই প্রগতির যুগে কাগজ ভরিয়ে ভরিয়ে ওসব লেখার দরকার-ই বা কি আর পড়ে দেখার প্রয়োজনীয়তাটাই বা কোথায়। যা লিখতে চাও তাকে একটা পূর্নাঙ্গ কি আটা আনা, চার আনা পৌনে দ্যু আনা দৈর্ঘ্যের ছায়াছবিতে রূপ দিয়ে দিলেই তো হয়।

 

চেতন ভগত তো শুনেছি আগে কোন চিত্রপরিচালক সিনেমা বানাবে সেটা ঠিক করে তারপর উপন্যাস লেখায় হাত দেয়। Go green boys. জানেন না, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ পৃথিবীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। গরমে মেরু প্রদেশের হিমবাহ তো দূরের কথা মাথার ঘিলু অব্দি গলে যাচ্ছে। এবার এমন গরম পড়েছে যে বগলের ঘামের গন্ধ দূর করতে পাঁচ লক্ষ মেট্রিক টন ট্যালকম পাউডার বিক্কিরি হয়েছে। অতএব কাগজের কারবারে নেই আমি। গাছ বাঁচাতে হবে। আমি সৃষ্টি করব আলো, শব্দ, মানুষের হাসি কান্না আর প্রয়োজনমত যৌনতার সিকনি দেওয়া সেলুলয়েড ম্যাজিক। সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ। ফেসবুকে আজকাল দেখি রাম-শ্যাম-যদু-মধু, যত রাজ্যের সব romantic fool, ন্যাকড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম, কিসব লেখা পরিবেশনা করছে নিত্য। আসলে ওরা তো টেনিদা ঘনাদার আগে এগোতে পারে নি। আমার বুকশেলফ জুড়ে আলো করে থাকে দেরিদা  - বিনির্মাণ বা deconstruction theory-র জনক সেই মহান বস্তুবাদী চিন্তাবিদ। আমার ক্রিয়েটিভিটি ভাই একটা লেভেল ওপরে। বাপেরও বাপ আছে কিনা। আমি থাকি ইউটিউবে। না শুধু ইউটিউবে কেন থাকব, আমার ছবি লোকে রীতিমতো পয়সা দিয়ে দেখতে আসে। না না হলে আসেনি, তবে আড্ডাটাইমস, হইচই ইত্যাদি অ্যাপে রেগুলার হই হই করে রিলিজ হয় আমার শর্টফিল্ম। বাংলা চ্যানেলগুলোতে তো শ্বাশুড়ি বৌ-এর প্যানপ্যানানি, রোজকার সাংসারিক কাজিয়া দাঙ্গা আর অতিনাটকীয়তা। কিন্তু এই নতুন অনিয়ন্ত্রিত মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে আমার ফ্রেশ কন্টেন্ট, আমার অত্যাধুনিক জীবনদর্শন সরাসরি পৌঁছে যায় অগণিত সুধী দর্শকবৃন্দের কাছে। আমার প্রত্যেকটা ছবি সুপারডুপার হিট। আরে বাবা সমকালীন দর্শকের নাড়িটা আমি বুঝি।

 

ধরুন ছবি করার জন্য নায়িকা পেলাম কিন্তু নায়িকার কাছে অভিনয় পেলাম না। কোই পরোয়া নেহি। টাইট টিশার্ট পরিয়ে দাও। যত তাকে নিটোল, ডাঁটো দেখাবে তত হুড়হুড় করে viewership - বুঝলেন কিনা। আর ছবির নায়ক যদি ন্যাশনাল ইনসিটিউট অফ ফিল্ম অ্যান্ড ফাইন আর্টস থেকে ক্লাস ফোর ফেল হয়, অভিনয় করতে গিয়ে প্যান্ট ভেজায় তাহলে? না না জামা খুলে কাজ হবে না...আরে আমাদের দর্শক হল গিয়ে বাঙালি - যার আর এক প্রতিশব্দ হল আঁতেল। সলমন খানের সাথে নো দিলচস্তি আর সলমন খানীয় মুভিজ-এর সাথে জাতি দুশমনি। আমার প্রোটাগনিস্ট অভিনয়ে ছড়ালে আমি ওর মুখে উদম খিস্তি ভরে দিই। তাহলেই আমার শিল্প তার শৈল্পিক দ্যুতি নিয়ে রাতের লন্ডন শহরের মতই ঝক্‌ঝক্‌ করে। কি বললেন? অতো গালাগালি পছন্দ করেন না? পুরুষ তো নাকি আপনি? আপনার ঐটা ঐ হয় তো? না হলে চিন্তার কারণ নেই, আমার ছবি দেখলে হবে, জাপানি তেলের ইম্পোর্ট বন্ধ করব বলেই কিনা আমি ছবি বানাই। আমার বাপ ঠাকুর্দা স্বদেশি করত বাওয়া। আমিও করি আমার মত করে। গালাগালিতেই পুরুষ মানুষের পৌরুষ মশাই। আরও ভাল হয়, ফিমেল প্রোটাগনিস্টকে দিয়ে কটা কাঁচা খিস্তি করাতে পারলে। নায়িকার নরম ঠোঁট আর গরম শরীরের মাখো মাখো নেশায় গালাগালিগুলো অন্য মাত্রা পাবে, অন্য একটা আঙ্গিক। গালাগালি তো নয়, যেন প্রিয়ার পায়রা-গরম বুক।

 

প্রিয়া বলতে মনে পড়ল, রাতপোশাকে একটা ফরাসি স্টাইল লম্বা চুমুর সাথে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য কিন্তু রাখতে হবে। রিয়েল লাইফ-এর প্রতিফলন রীল লাইফ-এ না হলে শিল্প কি করে হল? সানি লিয়নের রাতপোষাকে নিজের স্বামী কন্যার সাথে ছবি পোষ্ট করা দেখে যে লোকগুলো ছিৎকারে টুইটার স্ট্রীমে প্লাবন এনেছেন, তাঁরাই দেখবেন আপনার স্বল্পবাসী-অনায়াসী-প্রেমপিয়াসী সীন দেখে কেমন ধন্য ধন্য করছেন। তবে যদি নায়কের মুখে হেভি গন্ধ হয়, নায়িকা যদি অমন ক্লোজআপ-দিয়ে-দাঁত-না-মাজা মুখের ক্লোজআপে যেতে না চায় তবে এক কাজ করুন না। প্রথম সীনে ঘর অন্ধকার করে একটু শীৎকার শুনিয়ে দিন। না না চিৎকার না, শীৎকার।  ও শীৎকার শব্দটা শোনেন নি? ওই ইংরেজিতে যাকে মোনিং বলে। একটা জিনিস লক্ষ করেছেন? দেখুন ইংরেজিতে সব শব্দ কেমন চমৎ্কার বলা যায়। বাংলায় বলতে কেমন ইয়ে ইয়ে করে। যাকগে, ঐ অন্ধকার ঘরে প্রথমে মোনিং শুনিয়ে তারপর ধীরে ধীরে আলো ফোটান। “আরও কিছু হবে” এই প্রতীক্ষা নিয়ে দর্শককে বাকি ছবিটুকু গিলিয়ে দেওয়া যাবে যেমন করে নেতারা উন্নয়ন দেবেন বলে আমাদের মত উন্নাসিকদের দিয়ে ভোট দিইয়ে নেন আর কি!

 

আর একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে - সেটা হল প্লট। এমনভাবে প্লটটা আপনার ব্রেনের বাঁ পাশ বা ক্রিয়েটিভ সাইড দিয়ে প্লট করে ফেলুন যাতে গল্পটা দর্শকদের ব্রেনের ডান পাশ বা যুক্তিবাদের পাশ ঘেঁষে সোজা মহাশূন্যে ছুটে যায়। দর্শক যত কম বুঝবে, তত নম্বর বেশি দেবে। আই মীন বুঝলেন না এরকম ছবিকেই বলে “open for interpretation”. The matrix ছবিটা দেখেন নি? অন্তত বার তিনেক না দেখলে বোঝা যায় না। সেইরকম। শুধু কালজয়ী ছবি বানাতে হলে ম্যাট্রিকস-এর সাথে একটা পার্থক্য রাখবেন। আপনার ছবি যেন তিরিশ বার দেখলেও কেউ ধরতে না পারে। চিন্তা নেই। একবারের বেশি এমনিও কেউ দেখবে না। অজস্র শর্টফিল্ম দেখতে হয়, তার ওপর শুক্রবার থেকে রোববার রাত অব্দি মদ খেতে হয় - অনেক কাজ। কিন্তু আপনার শর্টফিল্ম বুঝতে না পারলে নিশ্চিত হাই রেটিং দেবে আপনাকে। আর নয়তো করতে পারেন "টুইস্ট পে টুইস্ট"। পনের মিনিটের মুভিতে প্রতি দু মিনিট একান্ন সেকেন্ড পর পর টুইস্ট ছাড়ুন। যখন দর্শক ভাবছে ব্যাপারটা ক, তখন ঠক করে দেখিয়ে দিন ব্যাপারটা আদতে খ। কিছুক্ষণ হাল্কা আঁচে কষুন। যখন দর্শক নিঃসন্দেহ ব্যাপারটা তাহলে খ, বলে বসুন ব্যাপারটা আসলে গ। এতক্ষণে আপনার দর্শকের কল্পনার গরু কল্পতরুতে চেপেছে। মিস্টার এক্স বলছে ব্যাপারটা চ, মিস ওয়াই বলছে ব্যাপারটা ড-এ শূন্য ড়, মিস্টার জেড দাড়ি (ফ্রেঞ্চ কাট) চুলকোচ্ছে আর ভাবছে মিস্টার এক্স আর মিস ওয়াইকে টেক্কা দিয়ে কিভাবে একটা জুতসই প্রেডিকশান করা যায়। এমন সময় বলে দিন ব্যপারটা আসলে ছিল চন্দ্রবিন্দু। এইবার ঝুপ করে লাইট নিভিয়ে কুশীলবদের নাম দেখাতে শুরু করুন। মিস্টার এক্স, মিস ওয়াই, মিস্টার জেড সবাই একযোগে বেকুব বনে গিয়ে intellectually satisfying সিনেমা দেখতে পাওয়ার আনন্দে উৎসাহে ধন্য ধন্য করবে আর এক পেগ এক্সট্রা দারু খেয়ে নেবে। Guaranteed.

# # #

[This article was originally published in the commemorative magazine for the Chicago Bengali Film Festival 2019 (CBFF2019), organized by CHHOBIGHAR, the Bengali film society in Chicago, on September 7th, 2019.

bottom of page